ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় আজকাল হরহামেশা দেখা যায়, রান্নার তেল বিক্রি করা ট্রাকের পেছনে মানুষের দীর্ঘ সারি। গত জুলাই থেকে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানীতে পাইকারি দরে তেল কিনতে তীব্র গরম, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকছে বাসিন্দারা। এ ধরনের ট্রাক থেকে প্রতি কেজি তেল তিন হাজার কিয়াটে (১৪৯ টাকা প্রায়) পাওয়া যায়, খোলা বাজারে কিনতে গেলে যার দাম পড়বে প্রায় দ্বিগুণ। এরপরও এক বছর আগের দামের তুলনায় ট্রাক থেকে কেনা ভোজ্যতেলের দাম পড়ছে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
অভ্যুত্থান-পূর্ব মূল্যের তুলনায় বর্তমানে এক তৃতীয়াংশ কমে লেনদেন হচ্ছে কিয়াট। পাম তেল, পেট্রল, ওষুধের মতো পণ্যের চাহিদা মেটাতে আমদানির ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশের জন্য এটি বড় বিপর্যয়। বিশ্বব্যাংক বলছে, মিয়ানমারের ৪০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় এখন চার মার্কিন ডলারেরও কম (২০১৭ সালের মূল্যে)। দেশটিতে আধা-বেসামরিক শাসনের অধীনে প্রায় এক দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মুছে দিয়েছে সামরিক জান্তা।
কিন্তু সংকটের দায়ভার নেওয়ার পরিবর্তে জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং জনগণকে কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তরকারি রান্নায় ব্যবহৃত তেলের পরিমাণ নিয়ে অসন্তুষ্ট তিনি। কিন্তু এটি মূলত হ্লাইংয়ের আসল উদ্বেগ ঢাকার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। তার বড় দুশ্চিন্তা মিয়ানমারের বর্তমান অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স নিয়ে।
দেশটির ‘অভ্যন্তরীণ শক্তি’ বাড়াতে ও অর্থপ্রদানের ভারসাম্য আনতে ভোক্তা চাহিদা কমানো, অভ্যন্তরীণ তেল-ফসলের উৎপাদন বাড়ানো এবং বন্ধ রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলো ফের চালু করতে চায় জান্তা সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে মিয়ানমারের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে জেনারেলদের নীতিগুলো পড়লে পাগলামিই মনে হবে। এর আগে ১৯৬২ ও ১৯৮৮ সালে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পরের সময়গুলোতে ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের দরকার হয়েছিল।
এবারের অভ্যুত্থানের পরপরই জান্তা শাসকরা প্রথম যে ঘোষণা দেন তা হলো, এক বছর জরুরি অবস্থা জারি থাকবে। পরে এর সময়সীমা দুই বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয় এবং এরপর নতুন নির্বাচন হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সামরিক জান্তা। অভ্যুত্থানের পর অনিবার্য অর্থনৈতিক পতন মোকাবিলায়ও তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাদের।
কিয়াটের প্রাথমিক দরপতন ঠেকানোর চেষ্টায় মিয়ানমারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রায় ৬০ কোটি মার্কিন ডলার (মোট রিজার্ভের আনুমানিক ১০ শতাংশ) বিক্রি করে দেয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এপ্রিল মাসে গিয়েও রিজার্ভ কমা অব্যাহত ছিল। কারণ বিদেশি বিনিয়োগ, সহায়তা, রেমিট্যান্স- সবই কমে গিয়েছিল এবং পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় পুঁজি নিয়ন্ত্রণ ও আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করে জান্তা সরকার।
কিন্তু এই পদক্ষেপে ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের ওষুধসহ আমদানি করা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর ঘাটতি তৈরি হয়। রপ্তানিকারকদের জন্য সরকার নির্ধারিত হারে বৈদেশিক মুদ্রার মুনাফা কিয়াটে রূপান্তর করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় বণিজ্য বন্ধ করে দেন অনেকে। জান্তা সরকারের জন্য নিজেদের আয়ের একটি অংশ হারানোর বদলে মুনাফা বিদেশে রেখে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেন কেউ কেউ।
পরবর্তীতে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করে পরোক্ষভাবে হলেও বিশৃঙ্খলার জন্য নিজেদের দায় স্বীকার করেন জেনারেলরা। আগস্টের মাঝামাঝি গিয়ে জান্তা সরকার ঘোষণা দেয়, রপ্তানিকারকরা তাদের বৈদেশিক আয়ের এক-তৃতীয়াংশ রাখতে পারবে অথবা তা দিয়ে বাজার দরে কিয়াট কিনতে পারবে।
কিন্তু ব্যবসায়িক লাভের জন্য বাজারে যে নিশ্চয়তা দরকার হয়, সামরিক জান্তার কাছ থেকে সেটি আসার সম্ভাবনা কম। গত জুন মাসে হ্লাইং তার ছয়জন লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পদে নিযুক্ত করেন। জান্তা প্রধানের ঘনিষ্ঠ লেফটেন্যান্ট-জেনারেল মো মিন্ট তুন এখন বিনিয়োগ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা তত্ত্বাবধানকারী কমিটির নিয়ন্ত্রক।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রচেষ্টা পৃষ্ঠপোষকতার জায়গা তৈরি করে। মিন অং হ্লাইং হয়তো মিয়ানমারের আগের জান্তাদের জন্য সহায়ক হওয়ায় ধনকুবের শ্রেণি পুনর্গঠনের আশা করছেন। কিন্তু সেটি অনেক কঠিন হবে বলে মনে করেন সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জেরার্ড ম্যাকার্থি।
যেসব ধনী ব্যবসায়ী তাদের পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যময় করতে এক দশক কাটিয়েছেন, তারা আরেকটি জান্তার ফাঁদে পড়তে চাইবেন না। তাছাড়া, এই সরকার যেহেতু বলছে, তারা পদত্যাগ করবে এবং ক্রমাগত জাতিগত ও গণতন্ত্রপন্থি গেরিলাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে, তাই তাদের পক্ষে বাজি ধরার মতো লোকও খুব বেশি নেই। বিদ্রোহীরা সফল হলে শাস্তির ভয় রয়েছে জান্তা সরকারের সহযোগীদের।
ম্যাকার্থি বলেন, আপনি সম্পূর্ণ নতুন একটি ব্যবসায়িক শ্রেণি তৈরি করতে পারবেন না, যা এক বা দুইজন জেনারেলের কাছে ঋণী। জান্তা সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত একটি নতুন নির্বাচনী প্রশাসনে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা না করছে বা পথিমধ্যে ধসে না পড়ছে, ততক্ষণ বিদ্যমান ব্যবসায়িক অভিজাতরা কালক্ষেপণ করবেন বলেই মনে হয়।
(দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অবলম্বনে, অনুবাদ করেছেন খান আরাফাত আলী)
পাঠকের মতামত